রিয়েল এস্টেটে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি: আবাসন খাতে বিপ্লব, নাকি  অজানা ঝুঁকি? জানুন এর সুবিধা, সম্ভাবনা ও আসন্ন চ্যালেঞ্জ।

রিয়েল এস্টেটে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি

ফ্ল্যাট বা প্লট কেনার কথা ভাবলেই আগে কেমন ছবি ভেসে উঠতো বলুন তো? একগাদা ব্রোশিউর, বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি, আর ঘন্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকা – কী একটা হয়রানি! কিন্তু যুগ পাল্টেছে! আচ্ছা, আমি যদি বলি এখন আপনি ঢাকার অভিজাত এলাকার একটা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা কক্সবাজারের সমুদ্রের ধারের কোনো কটেজ ঘরে বসেই ঘুরে দেখতে পারবেন, বিশ্বাস করবেন? হ্যাঁ, এটাই সম্ভব করেছে রিয়েল এস্টেটে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বা ভিআর প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিটা কিন্তু এখন আর শুধু গেম বা বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; বরং আমাদের দেশের রিয়েল এস্টেট শিল্পেও রীতিমতো বিপ্লব ঘটাতে শুরু করেছে। কীভাবে এই জাদুকরী প্রযুক্তি প্রপার্টি কেনা-বেচার পুরো প্রক্রিয়াটাকেই বদলে দিচ্ছে, এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই কীভাবে লাভবান হচ্ছেন, আর ভবিষ্যৎেই বা এর সম্ভাবনা কতখানি। চলুন, এই ভার্চুয়াল দুনিয়ার বাস্তব প্রভাবটা একটু তলিয়ে দেখি!

রিয়েল এস্টেটে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) আসলে কী? (একদম সহজ ভাষায় বুঝুন)

  • এটি কম্পিউটার-জেনারেটেড সিমুলেশন যা ব্যবহারকারীকে একটি কৃত্রিম পরিবেশে বাস্তবসম্মত অভিজ্ঞতা দেয়।
  • বিশেষ হেডসেট ও কন্ট্রোলারের মাধ্যমে এই অভিজ্ঞতা নেওয়া যায়।
  • রিয়েল এস্টেটের ক্ষেত্রে, এটি একটি নির্মীয়মাণ বা প্রস্তুত অ্যাপার্টমেন্ট/বাড়ির ভেতর-বাহির ৩৬০-ডিগ্রিতে দেখায়।

সুবিধা: ভালো দিক: মনে হবে যেন আপনি নিজেই সেই জায়গাটায় উপস্থিত আছেন।

অসুবিধা (প্রচলিত ধারণা): অনেকেই ভাবেন এটা শুধু দামি গ্যাজেট, সাধারণ মানুষের জন্য নয়। (এই ধারণা ভাঙতে হবে)

আগে কেমন ছিল আর এখন কেমন? প্রপার্টি দেখার অভিজ্ঞতায় VR-এর অসাধারণ প্রভাব। 

আগের পদ্ধতি (ট্র্যাডিশনাল):

  • একাধিক সাইট ভিজিট করতে হতো, যা সময়সাপেক্ষ ও কষ্টকর।
  • ছবি বা ভিডিওতে পুরো ধারণা পাওয়া যেত না।
  • নির্মীয়মাণ প্রজেক্টের ক্ষেত্রে শুধু নকশা বা থ্রিডি মডেলের ওপর নির্ভর করতে হতো।

VR-এর মাধ্যমে নতুন অভিজ্ঞতা:

  • ঘরে বসেই অসংখ্য প্রপার্টি ভার্চুয়ালি “ভিজিট” করা যায়।
  • স্পেস, লেআউট, আলো-বাতাস সম্পর্কে বাস্তবসম্মত ধারণা পাওয়া যায়।
  • ইন্টেরিয়র ডিজাইনের বিভিন্ন অপশন ভার্চুয়ালি দেখে নেওয়া যায়।

সুবিধা: সময়, শ্রম ও যাতায়াত খরচ বাঁচে।

অসুবিধা (যদি থাকে): বাস্তব স্পর্শ বা গন্ধের অনুভূতি না পাওয়াটা এর একটি ঘাটতি, যা কারো কারো জন্য সমস্যার।

ক্রেতাদের জন্য রিয়েল এস্টেটে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহারের দারুণ সব সুবিধা (সময় বাঁচান, সঠিক সিদ্ধান্ত নিন)

সুবিধাজনক ও সময় সাশ্রয়ী:

  • অফিসে বসে, ছুটির দিনে বা যেকোনো অবসরে প্রপার্টি দেখা যায়।
  • বিশেষ করে প্রবাসী ক্রেতা বা যারা দূরে থাকেন, তাদের জন্য আশীর্বাদ।

উন্নত সিদ্ধান্ত গ্রহণ:

  • প্রপার্টির প্রতিটি কোণ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়।
  • একাধিক প্রপার্টির তুলনা করা সহজ হয়।
  • নির্মীয়মাণ প্রজেক্টের ক্ষেত্রে কাজ শেষ হওয়ার আগেই বাস্তব ধারণা পাওয়া যায়।

খরচ কম:

  • প্রাথমিক পর্যায়ে সাইট ভিজিটের খরচ কমে আসে।

আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতা:

  • প্রপার্টি দেখার গতানুগতিক পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি ইন্টারেক্টিভ ও আকর্ষণীয়।

সুবিধা: কম সময়ে বেশি প্রপার্টি দেখে শর্টলিস্ট করা যায়।

অসুবিধা (সীমাবদ্ধতা): সবার কাছে VR হেডসেট না থাকা বা ব্যবহারে অভ্যস্ত না হওয়া একটা প্রাথমিক বাধা।

ডেভেলপার ও বিক্রেতাদের জন্য ভিআর (VR) কেন আশীর্বাদস্বরূপ? (খরচ কম, গ্রাহক বেশি)

বৃহত্তর ক্রেতা আকর্ষণ:

  • দেশের যেকোনো প্রান্ত, এমনকি বিদেশের সম্ভাব্য ক্রেতাদের কাছেও পৌঁছানো যায়।
  • তরুণ প্রজন্ম, যারা প্রযুক্তিতে স্বচ্ছন্দ, তাদের সহজে আকৃষ্ট করা যায়।

মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিং-এ নতুনত্ব:

  • প্রজেক্টের প্রতি আগ্রহ ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে।
  • প্রতিযোগীদের থেকে নিজেদের আলাদাভাবে উপস্থাপন করা যায়।

বাংলাদেশের কিছু স্বনামধন্য রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ইতোমধ্যে ভিআর প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে বা করার পরিকল্পনা করছে। 

খরচ সাশ্রয়:

  • ভিআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে মডেল ফ্ল্যাট তৈরির বিপুল খরচ এড়ানো সম্ভব।
  • সাইট ভিজিটের জন্য লজিস্টিকস খরচ কমে।

দ্রুত বিক্রি:

  • ক্রেতারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারায় বিক্রি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।
  • ভালো দিক: অফ-প্ল্যান প্রজেক্ট (নির্মাণের আগেই) বিক্রি করা সহজ হয়।

অসুবিধা: মানসম্পন্ন ভিআর কনটেন্ট তৈরি করা প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা ব্যয়বহুল হতে পারে।

বাংলাদেশে প্রপার্টি দেখার নতুন জাদু: বর্তমান প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত

যদিও রিয়েল এস্টেটে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার এখনও ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়নি, তবে বড় বড় শহরগুলোতে, বিশেষ করে ঢাকায় এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। মূলত বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ও কমার্শিয়াল স্পেস বিক্রির ক্ষেত্রে ভিআর প্রয়োগ বেশি দেখা যাচ্ছে।

অনলাইন প্রপার্টি পোর্টালগুলোর ভূমিকা:

  • কিছু পোর্টাল (যেমন: বিপ্রপার্টি, বিক্রয় ডট কম) তাদের লিস্টেড প্রপার্টির জন্য ৩৬০-ডিগ্রি ভিউ বা ভার্চুয়াল ট্যুরের অপশন রাখছে।

তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ:

  • নতুন প্রযুক্তির প্রতি তরুণ ক্রেতাদের আগ্রহ এই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ডেভেলপারদের বিনিয়োগ:

  • কিছু দূরদর্শী ডেভেলপার কোম্পানি নিজস্ব ভিআর স্টুডিও তৈরি করছে বা থার্ড পার্টির সাহায্য নিচ্ছে।

“রিহ্যাব ফেয়ার”-এর মতো আবাসন মেলাগুলোতেও এখন ভিআর প্রযুক্তির প্রদর্শনী দেখা যায়, যা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে।

রিয়েল এস্টেটে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহারের চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা (বাস্তব সমস্যা যা আমাদের দেশে আছে)

উচ্চগতির ইন্টারনেটের অভাব:

  • মসৃণ ভিআর অভিজ্ঞতার জন্য ভালো মানের ইন্টারনেট সংযোগ অপরিহার্য, যা এখনও সারাদেশে সহজলভ্য নয়।

প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও সরঞ্জাম:

  • ভিআর হেডসেট এখনও অনেকের কাছে নতুন এবং কিছুটা ব্যয়বহুল।
  • সাধারণ মানুষের মধ্যে এটি ব্যবহারের পরিচিতি কম।

কনটেন্ট তৈরির জটিলতা ও খরচ:

  • উচ্চমানের ভিআর কনটেন্ট তৈরি করতে দক্ষ জনবল ও সময় প্রয়োজন।

বাস্তব পরিদর্শনের প্রয়োজনীয়তা:

চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে অনেকেই একবার হলেও স্বচক্ষে প্রপার্টি দেখতে চান। ভিআর কখনই শতভাগ বাস্তব পরিদর্শনের বিকল্প হতে পারে না।

অসুবিধা: প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা নিম্নমানের ভিআর অভিজ্ঞতা ক্রেতাদের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরি করতে পারে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: ২০২৫ ও তার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেটে VR-এর ভূমিকা

ব্যাপক ব্যবহার:

  • ইন্টারনেট সহজলভ্য হলে এবং ভিআর ডিভাইসের দাম কমলে এর ব্যবহার আরও বাড়বে।
  • ছোট ও মাঝারি ডেভেলপাররাও এই প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী হবেন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি (AR) এর সমন্বয়:

  • ভিআর ট্যুরের সাথে এআই যুক্ত হয়ে ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী ইন্টেরিয়র বা ফার্নিশিং কাস্টমাইজ করে দেখানোর সুযোগ তৈরি হবে।
  • এআর ব্যবহার করে খালি প্লটে বাড়ি কেমন দেখাবে তা মোবাইলের মাধ্যমেই অনুভব করা যাবে।

সম্পূর্ণ ডিজিটাল প্রক্রিয়া:

  • ভার্চুয়াল ট্যুর থেকে শুরু করে ডিজিটাল পেমেন্ট ও ডকুমেন্টেশন – পুরো প্রক্রিয়া অনলাইন-ভিত্তিক হওয়ার সম্ভাবনা।

স্মার্ট সিটি ও মেগা প্রজেক্ট:

বাংলাদেশের চলমান ও ভবিষ্যৎ স্মার্ট সিটি এবং মেগা প্রজেক্টগুলোর পরিকল্পনা ও বিক্রিতে ভিআর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

পরিশেষে: 

সত্যি বলতে কি, রিয়েল এস্টেটে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আর কোনো সায়েন্স ফিকশন নয়, এটা এখন জলজ্যান্ত বাস্তব। হ্যাঁ, আমাদের দেশে এর চলার পথে কিছু চ্যালেঞ্জ হয়তো আছে, কিন্তু সম্ভাবনাটা বিশাল। একবার ভাবুন তো, ঘরে বসেই যদি আপনার স্বপ্নের বাড়িটা খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে সময় আর শ্রম দুটোই কতটা বেঁচে যায়! ক্রেতাদের জন্য যেমন এটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াকে সহজ করছে, তেমনই ডেভেলপারদের জন্যও খুলে দিচ্ছে ব্যবসার নতুন দিগন্ত। আমার বিশ্বাস, আগামী দিনে এই প্রযুক্তি বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট বাজারকে আরও স্বচ্ছ, আধুনিক এবং ক্রেতাবান্ধব করে তুলবে। প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে, এই খাতে একটা নতুন যুগের সূচনা হবে। 

join the success

Let’s create something extraordinary together

Schedule a free consultation with our team and let’s make things happen!